বৃহস্পতিবার, ৩১ Jul ২০২৫, ০৫:৩৪ পূর্বাহ্ন
হোসাইন মোহাম্মদ সাগর
২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসেই বাংলাদেশের বিভিন্ন আদালতে দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের সংখ্যা ছুঁয়েছে ৬০-এর ঘর। বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত যে হারে এই সাজা ঘোষিত হয়েছে, তা এক দশকে নজিরবিহীন। নারীর প্রতি সহিংসতা, শিশু ধর্ষণ, পারিবারিক কলহ, জমি নিয়ে বিরোধ কিংবা দলবদ্ধ ধর্ষণের মতো বিভিন্ন ঘটনায় একের পর এক আসামির বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তি ঘোষণা করেছে আদালত।
এই সময়ে ঘোষিত মৃত্যুদণ্ডের রায়গুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অপরাধের ধরন যতই বৈচিত্র্যপূর্ণ হোক না কেন, আদালতের রায় প্রায় একই রকম—মৃত্যুদণ্ড। যেন এটাই বিচার ব্যবস্থার একমাত্র কঠিন ও দৃশ্যমান প্রতিক্রিয়া। প্রশ্ন উঠেছে, এ কি বিচারপ্রক্রিয়ার বিকাশ, নাকি জনআবেগে প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রীয় প্রতিশোধ?
সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষণ কিংবা নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনায় শিক্ষার্থী ও জনসাধারণ রাস্তায় নেমেছেন বারবার। ‘ফাঁসি চাই’ স্লোগান, প্রতীকী দড়ি, মশাল মিছিল—সবই যেন সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রকাশ হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই দাবি রাষ্ট্রীয় বিচারপ্রক্রিয়াকে কতটা প্রভাবিত করছে, সেটিই এখন বিশ্লেষণের বিষয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের অনাস্থা তাকে প্রতিশোধপরায়ণ করে তুলেছে। ফলে ন্যায়বিচার শব্দটি প্রায়শই সমার্থক হয়ে উঠেছে ফাঁসির দাবির সঙ্গে। অপরাধ প্রমাণ হলেই যেন মৃত্যুই তার একমাত্র প্রাপ্য—এই মনোভাব সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। অথচ ন্যায়বিচার শুধু শাস্তি নয়, প্রতিকার, সংশোধন এবং সমাজে অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঠেকানোর একটি প্রক্রিয়া।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের বড় একটি অংশই দরিদ্র, স্বল্পশিক্ষিত এবং আইনি সহায়তা থেকে বঞ্চিত। গবেষণা বলছে, উচ্চ আদালতে মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল থাকেও না অনেক সময়। জামায়াত নেতা আজহারুল ইসলামের মতো অনেকেই হাইকোর্টে খালাস পেয়ে যান। আবার অনেক মামলায় সাজা কমিয়ে দেওয়া হয়। ফলে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে উচ্চ আদালতের রায়, যা বহু বছর সময় নেয় এবং ততদিন আসামিকে থাকতে হয় মৃত্যুর অপেক্ষায়, এক অমানবিক মানসিক বন্দিত্বে।
২০১১ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত বছরে গড়ে ৩০ থেকে ৪০টি মৃত্যুদণ্ডের রায় হলেও ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে এই সংখ্যা ৬০ ছাড়িয়েছে। অর্থাৎ, এ বছর বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অপরাধ কমেছে কি? কিংবা প্রতিটি মামলায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়েছে?
মৃত্যুদণ্ডের সমর্থনে অনেকেই যুক্তি দেন যে এটি অপরাধ প্রতিরোধে কার্যকর। কিন্তু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এবং বিভিন্ন দেশের বিচারব্যবস্থার বিশ্লেষণ বলছে ভিন্ন কথা। ১০৬টি দেশে ইতিমধ্যে মৃত্যুদণ্ডের বিধান বিলুপ্ত হয়েছে। এমনকি যেসব দেশে এখনো এটি প্রযোজ্য, সেখানেও প্রয়োগের হার হ্রাস পাচ্ছে।
বাংলাদেশের মতো দেশে এই প্রবণতা উল্টো দিকে—মৃত্যুদণ্ড যেন হয়ে উঠেছে সহজ বিচার। অথচ এটি কখনোই আইনের চূড়ান্ত সফলতা হতে পারে না। বরং এটা বিচারপ্রক্রিয়ার একটি বিভ্রান্তিমূলক তাড়াহুড়ো, যেখানে প্রকৃত অর্থে অপরাধ নির্মূল হয় না, বরং কখনো কখনো নতুন অন্যায় তৈরি হয়।
এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে উঠেছে—আমরা কি বিচার চাচ্ছি, নাকি প্রতিশোধ? বিচারব্যবস্থা কি আবেগের প্রতিধ্বনি হয়ে উঠছে? নাকি প্রতিকারের সর্বোচ্চ পথ খোঁজার জায়গা?
২০২৫ সাল আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, মৃত্যুদণ্ডের সংখ্যা বিচারপ্রক্রিয়ার গুণমানের একমাত্র সূচক নয়। বরং এটা সমাজ, রাষ্ট্র ও আইনব্যবস্থার সম্মিলিত অসহায়তার এক প্রতিফলন।
আমরা যদি সত্যিকারের ন্যায়বিচার চাই, তবে আমাদের সাহস থাকতে হবে মৃত্যুদণ্ডের সীমা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে। শুধুমাত্র ‘ফাঁসি চাই’ চিৎকারে নয়, বরং বিচারব্যবস্থার মানবিকতা, কার্যকারিতা এবং সকল শ্রেণির মানুষের জন্য সমতা নিশ্চিতের মধ্যেই রয়েছে একটি সভ্য রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ।
হোসাইন মোহাম্মদ সাগর, ( মৃত্যুদণ্ড বিলোপ বিষয়ক মানবাধিকার কর্মী ও লেখক )
ইমেইল: sendhusagar@gmail.com